বেশ কিছুদিন হল বাংলাদেশ সরকার থেকে ধরপাকড় চলছে বিটকয়েনের মাইনার এর ওপর আসলে সেখানে কি চলছে, যত গভীরে পড়ালেখা করলাম বিটকয়েন নিয়ে তত বেশি আগ্রহ জন্মাতে থাকলো। যেমন ধরুন বিটকয়েনের সৃষ্টি ছদ্দবেশী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দ্বারা যাদের পরিচয় এখনও অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। নিজেদের পরিচয় দেয় তারা সাতোশি নাকামোতো নামে। সাতোশি নাকামোতো আড়ালে রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই পরিণত করেছে বিটকয়েন। কিন্তু সাতোশি নাকামোতো মাত্র একটা অংশ এই অবিশ্বাস্য খেলার মাঠে, সত্যি বলতে এটা একটা হোয়াইট ওয়ার্ল্ড কি চলছে সেখানে তা আমাদের মাথায় ঢোকানো বেশ কষ্ট। আর এ জন্যই মনে হলো এটাই সঠিক সময় আমাদের দর্শকদের কাছে কিছুটা সহজ ভাষায় ক্রিপ্টোকারেন্সি ও বিটকয়েন কি, কিভাবে কাজ করে বা ভবিষ্যতে কি হবে তা তুলে ধরা।
বিটকয়েন একটা গল্প আমাদের প্রভাবিত করার গল্প ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় আমরা মুদ্রা এবং অর্থব্যবস্থার যেরূপ আজকে দেখি তা কিন্তু এমনটা ছিল না। একটা সময় ছিল যখন মুদ্রার বদলে চালু ছিল বিনিময় প্রথা। অর্থাৎ কোন বস্তুর বদলে অন্য বস্তু বিনিময় করা। যেমন মাছের বিনিময় কিছু রুটি বা কিছু ডিমের খানিকটা ফোন ইত্যাদি। কিন্তু এই ব্যবস্থার সমস্যা হল আমার কাছে যা আছে তা অন্যের প্রয়োজন নাও হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে বিনিময় কিছু নিতে আমি পারব না। আমাদের পূর্বসূরিরা বুঝতে পারে যে বিনিময়ের জন্য তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কিছু একটা প্রয়োজন যে বিভিন্ন বস্তু বা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে অনেক কিছুই যেমন গবাদিপশুর ঝিনুক এবং একসময় দামি ধাতুর মুদ্রা এই কাজে ব্যবহৃত হতে শুরু হয। শত শত বছর পরে একসময় রাষ্ট্রগুলো কাগজের টাকা ব্যবহার করা শুরু করে জার্মান নির্ধারিত হয় সোনার মূল্য দ্বারা যেটাকে বলা হয় গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড।
কিন্তু 971 সালে এমেরিকা সহ আরো অনেক রাষ্ট্র গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড ট্যাগ করে এর মানে যারা এই যে ডলারের মান সোনা দিয়ে আর নির্ধারিত হবে না বরং তা নির্ধারিত হবে সরকারের নির্দেশ মোতাবেক এবং সকলের সম্মতিতে। এর মাধ্যমে টাকা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের ওপর সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুলো আরো বেশি ক্ষমতা পায় এবং আর্থিক সংকটের সময় মুদ্রানীতি পরিবর্তন হয়ে ওঠে আরও সহজ। এই ধরনের টাকাকে বলা হয় ফিয়াট মানি যার মান স্বর্ণ দ্বারা নির্ধারিত হয় না বরং নির্ভর করে সরকার এবং রাজ্য সরকারকে বিশ্বাস করি সেই বিশ্বাসের উপর, অর্থাৎ এই ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে সরকারের ওপর জনগণের ভরসা। কিন্তু কি হবে যদি আমরা সরকারকে বিশ্বাস না করি।
1980 দশকের শেষের দিকে সাইফার পাঙ্কের আবির্ভাব হয় যারা সরকারের মতো কেন্দ্রীয় প্রশাসন গুলোর বিরুদ্ধে ছিল, কারণ সরকার জনগণের তথ্য ব্যবহার করে তাদের ওপর নজরদারি চালাতে পারতো। সাইফার পাঙ্ক মানুষকে ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহারের উপদেশ দেয়, যার মাধ্যমে এই ধরনের নজরদারি ছাড়াই যোগাযোগ এবং তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব হবে। পরবর্তীতে বিটকয়েন প্রযুক্তি সাইফার পাঙ্ক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। 2007 এবং 2008 সালে একটা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট দেখা যায় যার মূল কারণ ছিল ব্যাংক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ উত্তোলন - এটা এমন প্রকট আকার ধারণ করে যে কারণে আমেরিকার সবচেয়ে বড় ব্যাংক গুলোর একটি পতন ঘটে যার নাম লিমেন ব্রাদার্স। 2008 সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময় হোয়াইট পেপার নামে একটি থিসিস পেপার এর আবির্ভাব হয় যার হেডলাইন ছিল (Bitcoin peer-to-peer electric gas system) এই পেপারের ছদ্ম লেখক এর ছদ্মনাম হচ্ছে সাতোশি নাকামোতো (Satoshi Nakamoto) - ৯ পৃষ্ঠার এই পেপারে নাকামোতো তার পেয়ার টু পেয়ার (peer-to-peer) ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেমটি ব্যাখ্যা করেন।
যার মাধ্যমে কোন প্রকার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাহায্য ছাড়াই ডিজিটাল মুদ্রা একজন আরেকজনের সাথে সরাসরি আদান-প্রদান করতে পারবে। নাকামোতো সাইফার পাংকের প্রযুক্তি ব্যবহার করেন যা বর্তমানে আমরা ব্লকচেইন প্রযুক্তি নামে চিনি। ম্যাথামেটিক্স কম্পিউটার সায়েন্স এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে না এমন এক মুদ্রা প্রবর্তন করেন যা কোন কেন্দ্রীয় প্রশাসন কে বিশ্বাস করা ছাড়াই আদান-প্রদান করা সম্ভব হবে। বিশ্বাসের সমস্যাটি সমাধান করাই ছিল বিটকয়েনের মূল লক্ষ্য। এখানে একটু থামি চলুন ইতিহাস তো বুঝলাম, কিন্তু বিটকয়েন জিনিসটা কি, কিভাবে কাজ, মানিব্যাগে নিয়ে কি ঘুরতে পারা যায়, কি যায়না না না বিটকয়েনের কোন বস্তুগত বা শারীরিক অস্তিত্ব একেবারেই নেই এটা সম্পূর্ণ ডিজিটাল একটা মুদ্রা। বিটকয়েন কিভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য ব্লকচেইন পদ্ধতি কি সেটা বোঝে টা জরুরী। বিটকয়েন সহজ ভাবে বুঝার জন্য এটাকে হিসাব খাতায় লিখে রাখার লেনদেনের হিসাব এর সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ব্যাংক মোটামুটি একই পদ্ধতিতে কাজ করে একটি একাউন্ট থেকে সারাদিনে কি লেনদেন হয়েছে তা ব্যাংক তার নিজস্ব সিস্টেমে রেকর্ড করে রাখেন এবং তার মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে যে লেনদেনগুলো বৈধ ছিল। এই ভাবেই তারা নিশ্চিত হয় যার ব্যাংকে এক লাখ টাকা আছে সে এক লাখ টাকার বেশি খরচ করতে পারবেনা। কিন্ত বিটকয়েন এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুদ্রার বিকেন্দ্রীকরণ এ কারণে বিটকয়েন ব্যবহার করে পিয়ার-টু-পিয়ার লেজার বা ডিস্ট্রিবিউট লেজার সিস্টেম যা নাকামোতো তার থিসিস পেপার ব্যাখ্যা করেছিলেন। অর্থাৎ লেজার বা হিসাব খাতা টি একটি কেন্দ্রীয় প্রশাসনের অধীনে থাকার বদলে বিটকয়েন নেটওয়ার্কের সকল কম্পিউটার বা নোট মধ্যে বিতরণ করে দেয়া হয়। এই নেটওয়ার্কে যে কেউ ঢুকতে পারে শুধুমাত্র বিটকয়েন সফটওয়্যার টি ডাউনলোড করে নেয়ার মাধ্যমে। যখনই কোনো লেনদেন সংঘটিত হবে প্রতিটি কম্পিউটার জটিল অ্যালগরিদম এর মাধ্যমে নির্ধারণ করবে লেনদেনটি বৈধ কিনা, যখন সারা নেটওয়ার্কের সকল কম্পিউটার সম্মত হবে যে লেনদেনটি বৈধ ছিল তখন লেনদেনটি লেজার হিসাব খাতা স্থায়ীভাবে লিখি নেয়া হবে। যদি একটা নির্দিষ্ট কম্পিউটার বা নোট একটি অবৈধ লেনদেন কে বৈধ দেখানোর চেষ্টা করেও, অন্য সকল নোট তা বাতিল করে দেবে।
এই প্রতিটি লেজার বা ব্লক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লেনদেনের হিসাব ধারণ করে , যা চেইন এর আগে লেজার সাথে যুক্ত থাকে এবং লেনদেনের সময় কোন পাবলিক পরিচয় ব্যবহার করা হয় না বরং প্রতিটি ব্যক্তির একটি পাবলিক এবং প্রাইভেট কিবা চাবি থাকে যা অনেকগুলো নাম্বার এবং অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত। প্রাইভেট কি ব্যবহার করা হয় একটা ডিজিটাল সিগনেচার এর জন্য এবং পাবলিক কি ব্যবহৃত হয় প্রাইভেট বৈধতা নিশ্চিত করার জন্য। ব্লকচেইন লেনদেনের এই বৈধতা নিশ্চিত করার পদ্ধতিকে বলা হয় মাইনিং। প্রতিটি ব্লক সফল ভাবে মাইন্ড করার জন্য প্রতিটি মাইনার পুরস্কার হিসেবে কিছুটা বিজ্ঞান পায় যাতে করে তারা মাইনিং এর কাজ পরবর্তীতেও করতে পারে। কেউ যদি কোনো একটি ব্লকে হ্যাক করে সেখানে অবৈধ কিছু করার চেষ্টা করে তাহলে পরবর্তী সকল ব্লক অবৈধ হয়ে যাবে। যে কারণে কোন ব্লক হ্যাক করা হয়েছে তা বের করা খুবই সহজ। কোন ব্যক্তি চাইলেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল ব্লকে এর লেনদেন দেখতে পারবে, কিন্তু তা পরিবর্তন করতে পারবেন। অর্থাৎ এটি এমন একটি মুদ্রা ব্যবস্থা যা কোন কেন্দ্রীয় প্রশাসনের উপ র বিশ্বাস করা ছাড়াই লেনদেন করতে সক্ষম। এমনই আজকের দিনেও বিটকয়েনের প্রথম ব্লকটি হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় যা সাতোশি নাকামোতো 2009 সালে মাইন করেছিলে। এই রেকর্ডে দেখা যায় যে সাতোশি নাকামোতো পুরষ্কার হিসেবে 50 বিটকয়েন দেয়া হয়েছিল প্রথম লোকই মাইন্ড করার জন্য। এই প্রথম দিকে সাধারণত জেনেসিস ব্লক বলা হয়। নাকামোতো সফটওয়্যার করে সাপ্লাই লিমিট নির্ধারণ করেছিল 21 মিলিয়ন। বর্তমানে মাত্র 2 মিলিয়ন বিটকয়েন বাকি আছে মাইন্ড করার জন্য। কিন্তু আরও একটা জরুরি প্রশ্ন কিন্তু রয়ে গেছে, কি করে বিটকয়েন আজকের এই দামে পৌঁছলো? এই ডিজিটাল মুদ্রা নিঃসন্দেহে প্রথম শ্রেণীর প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে তার এখনকার সময়ের দাম অনুযায়ী কি সত্যিই 63,503.90 ডলার হতে পারে কিনা এটা অবশ্যই চাহিদার প্রশ্নকারী। কিন্তু চাহিদা সৃষ্টি হলো কি করে?। 2009 সালে নাকামোতো তার থিসিস পেপার প্রকাশ করার পর সর্বপ্রথম জেনেসিস কি মাইন্ড করেন এবং এর ফলে পরবর্তীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যায় যা বিটকয়েনের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে।
প্রথমদিকে বিটকয়েন শুধুমাত্র শখের বশে মাইন করা হতো। 2010 সালের বিটকয়েনের কোন ব্যবহারিক দামি ছিল না তবে শীঘ্রই তা বদলে যায়। 2010 এর মে মাসে লাসজলো হ্যানেকজ (Laszlo Hanyecz) নামক এক ব্যক্তি বিটকয়েন একটি আলোচনা পুরান তৈরি করে যেখানে সে 10000 বিটকয়েনের জন্য দুটি বড় সাইজের পিজ্জা অফার করে। দুই দিন পর লাসজলো জানায় যে সে 25 ডলার এর সমতুল্য কিসের বিনিময়ে তার কাঙ্খিত বিটকয়েন নিতে সমর্থ হয়েছে এর ফলে এই প্রথমবার বিটকয়েন ব্যবহার করে কেউ কোন বস্তু কিনতে সমস্ত হয়। 22 মে কে তাই অফিশিয়ালি ভাবে বিটকয়েন পিকজা দিবস বলা হয়। সেই বছরের শেষের দিকে বিটকয়েনের দাম শূন্য থেকে 0.39 ডলার বৃদ্ধি পায় এবং প্রথমবারের মতো বিটকয়েনের সাথে সাধারণ টাকার সহজে লেনদেন এর জন্য মাউন্ট গক্স প্রতিষ্ঠিত হয়। 2011 সালে বিটকয়েনের দাম 1 ডলারে বৃদ্ধি পায় হঠাৎ করেই আরো কয়েকজনের ক্রিপ্টোকারেন্সি আসতে শুরু করে বাজারে যেগুলো এই একই ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি। কিন্তু যেখানে বিটকয়েনের উদ্দেশ্য ছিল ডিজিটাল মুদ্রা তৈরি সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি এর উদ্দেশ্য ছিল একেবারে আলাদা। যদিও তা একই ব্লক চেইন সিস্টেম ব্যবহার করে তৈরি হয়েছিল। প্রথম দিকের বেশকিছু স্ক্যান্দল এবং কুখ্যাতির কারণে বিটকয়েন প্রযুক্তিকে বেশ হেনস্থা হতে হয়। প্রাইভেট এবং পাবলিক কি ব্যবহারের কারণে বিটকয়েন ব্যবহারকারীর পরিচয় একেবারে গোপন থাকে এবং এর ফলে অপরাধী এবং সন্ত্রাসীরা এটাকে বিভিন্ন অবৈধ লেনদেনের ব্যবহার করে। এই কারণে আমাদের বাংলাদেশ এবং বিশ্বের আরো অনেক দেশই বিটকয়েন কে অবৈধ বলে ঘোষণা করে।
0 Comments